ভয়ংকর সময়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে বিশ্ববাসি। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী মানুষের জীবনকে করে দিয়েছে দুর্বিষহ। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে সঙ্গী করেই গেল দুই বছর জীবনযাপন করছে বিশ্বের মানুষ। তবে এই খারাপ সময়ের মধ্যেও আর্থবাউন্ড দর্শকরা উপভোগ করেছে ‘রিং অফ ফায়ার’, প্রত্যক্ষ করেছে সূর্যগ্রহণ, অন্ধকার আকাশে উপভোগ করেছে ব্যতিক্রমী বার্ষিক পারসিড উল্কা ঝর্না।

সর্বশেষ ডিসেম্বরে বিশ্ববাসি সাক্ষী হয়েছে একটি আশ্চর্য ধূমকেতু ‘লিওনার্ড’-এর। এদিকে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, ভাগ্য ভালো থাকলে ২০২২ সালে আরেকটি একটি ধুমকেতুর দেখা মিলতে পারে। যা আমাদের সৌরজগত দিয়ে ভ্রমণ করার সময় দৃশ্যমান হবে মানুষের জন্য। শুধু একজোড়া দূরবীন চোখ দিয়েই রাতের স্বচ্ছ আকাশে দেখা মিলবে অসংখ্য উল্কাবর্ষণ এবং চন্দ্র সংক্রান্ত নানা ঘটনা।

শুধু নক্ষত্রবিজ্ঞানীরা বা জ্যোতির্বিদরা নয়, এমন সুন্দর ঘটনার সাক্ষী হতে পারেন আপনি নিজেও। আর আপানদের ক্যালেন্ডারের সেসব দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা ২০২২ সালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ৮টি স্বর্গীয় ঘটনাকে চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছি, যা উত্তর আমেরিকার পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকেও দেখার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে।
২৪ মার্চ-৫ এপ্রিল: প্ল্যানেটারি ট্রিও

যদিও রাতের আকাশের নক্ষত্রগুলি পৃথিবী থেকে তুলনামূলকভাবে স্থির দেখা যায়। কিন্তু আমাদের হয়তো জানা নেই, সৌরজগতের গ্রহগুলো রাতের আকাশে সারাবছর নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে। চলতি বছরে, মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শুরুতে সূর্য ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে দক্ষিণ-পূর্ব দিগন্তের দিকে তাকালে আপনি ত্রি-গ্রহের ট্যাঙ্গো দেখতে পাবেন। এসময় শুক্র, মঙ্গল এবং শনি একসাথে অস্বাভাবিকভাবে কাছাকাছি অবস্থান করবে। তিনটি গ্রহের সমন্বয়ে তৈরি বলে একে বলা হয় ‘ট্রায়ো’। এসময় এই তিনটি গ্রহকে মানুষ খালি চোখে দেখতে পারে।

সবচেয়ে ভালোভাবে দেখার জন্য, আপনার কাছাকাছি একটি স্থান নির্ধারণ করুন যেখানে আকাশ সবচেয়ে অন্ধকার। তারপর দক্ষিণ-পূর্ব দিগন্ত বরাবর কয়েকটি স্থান বেছে নিন। গ্রহগুলোকে খুঁজতে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র চাঁদ থেকে শুরু করুন। আপনি চাঁদের ঠিক নিচ বরাবর তিনটি উজ্জ্বল বস্তু দেখতে পাবেন যেগুলো প্রায় সমান্তরালে অবস্থান করছে। উক্ত সময়ে প্রতিরাতে এই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। যেখানে তিন গ্রহের মধ্যে শনি ও মঙ্গল প্রতিদিন একটু একটু করে কাছে আসবে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের জন্য বানানো এক প্রতিবেদনে অ্যান্ড্রু ফাজেকাস জানান, ৪ এপ্রিলের ভোরে এই দুই গ্রহ সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থান করবে। এসময় শুক্র তাদের পূর্ব দিকে থাকবে।
৩০ এপ্রিল-১ মে: শুক্র-বৃহস্পতি সংযোগ
চলতি বছরে বসন্ত হবে গ্রহদের মিলনের সবচেয়ে ব্যস্ত ঋতু। ৩০ এপ্রিল থেকে ১ মে ভোরবেলায় বৃহস্পতি ও শুক্রের মধ্যে মিলন হতে দেখা যাবে। গ্রহ মিলনের সবচেয়ে সেরা দৃশ্য দেখার সাক্ষী হতে সূর্যোদয়ের প্রায় এক ঘন্টা আগে দক্ষিণ-পূর্ব আকাশে তাকাতে হবে। আর্থস্কাইয়ের মতে, যারা খুব ভোরে ওঠেন, তারা দুই গ্রহের সাথে চাঁদের মিলনের একটি দৃশ্যও ২৭ এপ্রিল সকালে দেখতে পাবেন।

৫ মে: উল্কা ঝর্না
আপনি বিশ্বের যেখানেই থাকুন, এদিন স্থানীয় সময় ভোর ৪টার দিকে পূর্ব আকাশের দিকে তাকান। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে হয়তো দেখবেন একরাশ নক্ষত্র ছুটে চলেছে। যেগুলি প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১০ থেকে ২০ উল্কা বেগে বৃষ্টির মতো ছুটছে। আর্থস্কাই’র মতে, যারা ৫ মে সকালে এই দৃশ্য দেখতে পাবেন না, তারা ৪ কিংবা ৬ মে এই দৃশ্যের সাক্ষী হতে পারবেন। এটি প্রায় ৭৫ বছর পর পর ফিরে আসে। ২০৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় এটি দেখা যাবে বলে জানিয়েছে জ্যোতির্বিদরা।

১৫ মে-১৬ মে: পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ
চাঁদ যেমন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে তেমন পৃথিবীও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এইভাবে একটা সময় চাঁদ, সূর্য, পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে এক সরলরেখায় আসে। যখন এই সরলরেখায় পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে আসে, তখন পৃথিবীর ছায়ার জন্য চাঁদে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, ফলে চাঁদকে তখন কিছু সময়ের জন্য দেখা যায় না। অর্থাৎ পৃথিবী পৃষ্ঠের কোনো দর্শকের কাছে চাঁদ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন একে সংক্ষেপে চন্দ্রগ্রহণ বলে। এই সময় পৃথিবী, সূর্যকে আংশিক ঢেকে নিলে পৃথিবীর জন্য চাঁদকে আংশিক দেখা যায় না, একে আংশিক চন্দ্রগ্রহণ বলে। আর পৃথিবী সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে নিলে পৃথিবীর জন্য চাঁদকে পুরোপুরি দেখা যায় না, একে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ বলে। ২০২২ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা তাদের অবস্থানের উপর নির্ভর করে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখতে পাবে।

১৪ জুন: বছরের প্রথম সুপারমুন
সুপারমুনের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ‘পেরিগি মুন’। পেরিগি অর্থ হচ্ছে ‘পৃথিবীর নিকটতম’। চাঁদ যখন পূর্ণ পূর্ণিমায় থাকে এবং বার্ষিক প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর আরও কাছাকাছি চলে আসে, তখন একে সুপারমুন বলা হয়। পৃথিবীর কাছাকাছি আসায় এই চাঁদকে স্বাভাবিক পূর্ণিমার চাঁদের তুলনায় বড় ও বেশি উজ্জ্বল দেখায়। একুওয়েদার.কম-এ দেয়া এক প্রতিবেদনে ব্রায়ান লাডা বলেন, চলতি বছরের গ্রীষ্মে পরপর ৩টি সুপারমুন দেখা যাবে। প্রথমটি জুন মাসের ১৪ তারিখ। এরপর ১৩ জুলাই এবং সর্বশেষটি আগস্ট মাসে। ১৪ জুন দক্ষিন-পূর্ব দিগন্তে রাত ৯টায় এ দৃশ্য দেখা যাবে, যা পরের দিন সকাল পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকবে।

১৯ জুন থেকে ২৭ জুন: এক সারিতে পাঁচ গ্রহ
মহাকাশে চলছে প্রতিনিয়ত নানান রকম রহস্যময় ঘটনা। চাঁদের পাশে এক সারিতে আসতে চলেছে মহাকাশের পাঁচ গ্রহ। তবে মজার বিষয় হলো, এমন বিরল দৃশ্য দেখার জন্য কোনো দামি লেন্স বা টেলিস্কোপের দরকার নেই। খালি চোখেই স্পষ্ট দেখা যাবে চাঁদের পাশে সৌরজগতের পাঁচ গ্রহের সমারোহ। এরজন্য সঠিক সময়ে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠতে হবে। কারণ, সূর্যোদয়ের একঘণ্টা আগে এই মহাজাগতিক ঘটনাটি ঘটবে। চাঁদের পাশে এক সারিতে পাশাপাশি দেখা যাবে বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি-এই পাঁচ গ্রহকে। অস্ট্রোনমি এডুকেটর জেফ্ররে হান্ট জানিয়েছেন।

সূর্যোদয়ের ঠিক একঘণ্টা আগে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেখাবে শুক্র, বুধ, শনি এবং বৃহস্পতিকে। চাঁদের ঠিক ডানপাশেই দেখা মিলবে বুধের। সেই অনুযায়ী কাল্পনিক রেখায় মিলিয়ে নিতে পারবেন বাকি চার গ্রহকেও। শুক্রকে দেখা যাবে পূর্ব থেকে উত্তরপূর্বে, মঙ্গল থাকবে দক্ষিণ পূর্বে, জুপিটার ও শনিকে দেখতে পাওয়া যাবে দক্ষিণ পশ্চিমে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতে, আগামী ১৯ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত খালি চোখে একসঙ্গে দেখা যাবে।

২৮ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই: ডেল্টা অ্যাকোয়ারিড উল্কা বৃষ্টি
বিজ্ঞানীদের মতে, মূলত ধুমকেতুর কণা বা গ্রহাণুর অংশ থেকে তৈরি হয় এক ধরনের বিরল উল্কা। এগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যখন প্রবেশ করে তখন আগুন ধরে যায়, তখনই তা জ্বলে ওঠে। আর তাতেই দেখায় উজ্জ্বল। তখন এটিকে উল্কা বৃষ্টি বলা হয়। এর আগে, ১৮২৫ সালে প্রথমবার উল্কা বৃষ্টি দেখা যায় সেই সময়ই প্রথম এই উল্কা বৃষ্টির আবিষ্কার হয়। এদিকে, মার্কিন মহাকাশ বিজ্ঞান কেন্দ্র নাসা বলছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে বায়ুমণ্ডলের অনেকটা অংশ জুড়ে দেখা যাবে উল্কা বৃষ্টি। এটি আসলে ‘ডেল্টা অ্যাকোয়ারিড’ নামে পরিচিত। ডেল্টা অ্যাকোয়ারিড হলো দীর্ঘতম চলমান উল্কা বৃষ্টিগুলির মধ্যে একটি।

আর্থস্কাইয়ের মতে, ‘ডেল্টা অ্যাকোয়ারিড’ উল্কা বৃষ্টি সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যাবে দক্ষিণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। রাতের আকাশ জুড়ে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১০ থেকে ২০টি উল্কা বর্ষণ ঘটবে। উল্কা বৃষ্টির সাক্ষী হতে আপনাকে ভোর হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে উঠতে হবে।

১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর: জেমিনিড উল্কা ঝর্না
একটি উল্কা ঝর্না একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যা ঘটে যখন রাতের আকাশে। উল্কা ঝর্না মূলত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উচ্চ গতিতে প্রবেশ করা বেশ কয়েকটি উল্কা দ্বারা সৃষ্টি হয়। উল্কাগুলোর আকার বড় না হওয়ায় এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার আগেই ধ্বংস হয়ে বৃষ্টির মতো প্রভাব সৃষ্টি করে।

সৌরজগতে বিভিন্ন ধরনের উল্কা ঝর্না রয়েছে। যেমন: অরিওনিড, কোয়াড্রেন্টিড, পারসিড, জেমিনিড এবং আরও বেশ কিছু। প্রতি বছর বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসে যে উল্কা ঝর্না দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম জেমিনিড উল্কা ঝর্না। ‘জেমিনিড মেটিওর শাওয়ার’ হলো একটি উল্কা ঝর্না, যার উৎস মিথুন রাশির দিক থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়।

এটি প্রতি দেড় বছরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং তার পথে ধুলো এবং পাথরের ট্রেইল ছেড়ে যায়। জেমিনিড অনুকূল পরিস্থিতিতে প্রতি ঘন্টায় ১২০ থেকে ১৬০টি উল্কা তৈরি করতে পারে। তবে এটি সারারাত স্থায়ী হয়না। চাঁদের আলো দূষণ এড়াতে ১৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে চাঁদ ওঠার আগে মিথুন রাশির দিকে তাকালে এটি দেখা যাবে। অথবা যারা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন, তারা চাঁদ অস্ত যাওয়ার পরের সময়টায় এটি দেখতে পেতে পারেন।

তথ্যসূত্র: স্মিথসোনিয়ান

 

কলমকথা/সাথী